শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১:৩৩ অপরাহ্ন
মুহাম্মদ আব্দুল বাছির সরদার:
‘সামান্য টাকার জন্য এভাবে মানুষকে হত্যা করতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারছেন না স্থানীয় লোকজন। যে পরিমাণ টাকা, তা না পেলেও হত্যা পরিকল্পনায় জড়িতদের কোন সমস্যা বা অভাব হতো না উল্লেখ করে পাশের গ্রামের লোকজন জানান, এমন নৃশংস ঘটনার সাথে জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি পাওয়া উচিত।’ গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার তাড়ল ইউনিয়নের মঙ্গলপুর গ্রামে গেলে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক লোকজন এমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। পরিবারের দাবি, রাষ্ট্র যেন এমন নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান করে আইনের শাসন বলবৎ রাখেন। অন্যথায় খুনিরা ছাড় পেয়ে সমাজে দুদু মিয়ার মত আরও অনেককে তাদের টার্গেটে পরিণত করবে।
পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, মঙ্গলপুর গ্রামের মৃত আব্দুল আলীর ছেলে দুদু মিয়া পরিবার-পরিজন নিয়ে চÐিপুর গ্রামের জুয়েল মিয়ার জায়গায় ঘর বানিয়ে বসবাস করতেন। এর সামান্য পশ্চিমেই চÐিপুর গ্রামের মৃত আব্দুল তোয়াহিদ মিয়ার ছেলে নাজমুল ও কবিরের মাছ ও গরুর খামার। এই সুবাধেই ৬ হাজার টাকা বেতনে চাকরী নেন দুদু। এক বছর আগে এই খামারে দুদু দুই বছর কাজ করার পর অসুস্থতার জন্য তা ছেড়ে দেন। তারা আরও জানান, খামার মালিক কবির মিয়ার কাছ থেকে দুদু মিয়া বেতনের চেয়ে ৬ হাজার ৮৭০ টাকা বেশি নিয়েছেন দাবি করে তা ফেরত দেয়ার জন্য বার বার চাপ দিচ্ছিলেন। টাকা দিতে না পারলে পুনরায় চাকরীতে যোগদান করতেও বলেন কবির। কিন্তু দুদু মিয়ার শারীরিক অসুস্থতার কারণে চাকরী করতে অপারগতা প্রকাশ করে তিনি টাকা ফেরত দেবেন বলে আশ্বাস দেন। কিন্তু অভাবের সংসার হওয়ার কারণে তা আর ফেরত দেয়া হয়নি।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, গত ২৭ এপ্রিল মঙ্গলবার বেলা ২টার দিকে ছোট ছেলের জন্য ঔষধ কিনতে ইসলামপুর পয়েন্ট যেতে বাড়ি থেকে বের হন। বেলা গড়িয়ে যাওয়ার পরও বাড়িতে না আসায় বিকেল ৪টায় তাকে কল দিলে মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। সন্ধ্যার পর ভাঙ্গাডহর গ্রামের আব্দুল মালিক, দোলন মিয়া ও ডাইয়ারগাঁওয়ের হাবুল দাস দুদু মিয়ার বাড়িতে এসে জানায়, সে বর্র্তমান নরোত্তমপুর গ্রামের ডাকাত মৃৃত আব্দুল কাইয়ুুমের স্ত্রী আল বাহারের সাথে পালিয়ে গেছে। দুপুরের আগে আল বাহার নিজে দুদুর বাড়িতে এসে জীবনের ভুল-ত্রæটির জন্য ক্ষমা চায় এবং যাওয়ার সময় মোবাইল নাম্বার নিয়ে যায়। সূত্র মতে, দুদু মিয়া নিখোঁজ হওয়ার সাথে সাথে কবির ও আল বাহারও নিখোঁজ হয়। পরিবারের লোকজন জানায়, একটি ন্যাক্কারজনক কথা শোনার পর আমরা তার খুঁজে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে যোগাযোগ করলেও স্থানীয় প্রশাসন ও গণ্যমান্য কাউকে অবগত করি নি। কোথাও তার সন্ধান না পাওয়াতে আমরা হতাশায় পড়ি। গত ১লা মে শনিবার বাড়ির উত্তরের মঙ্গলপুর বিলে মাছ ধরতে আসা লোকদের মাধ্যমে লাশ পড়ে থাকার খবর পাই। ঘটনাটি সাথে সাথে দিরাই থানা পুলিশকে জানাই। সন্ধ্যার পর ঘটনাস্থলে গিয়ে দুদু মিয়ার সন্তানেরা লাশ শনাক্ত করেন বলে জানান তার দ্বিতীয় ছেলে সুমন মিয়া ও তার চাচী গৃহবধু রাহিমা খাতুন।
তারা জানান, প্রথমে শুধুমাত্র মাথা, হাত-পা বিচ্ছিন্ন দেহ দেখতে পাই। পরে অনেক খোঁজাখুঁজি করে দুই পা ও এক হাত উদ্ধার করে পুলিশ। দুদু মিয়ার পায়ের আঙ্গুুল কিছুটা বাঁকানো থাকায় পরিবারের লোকজন শনাক্ত করে। পরদিন মাথা ও এক হাত উদ্ধার করা হয়। এরপর পুলিশ বাদি হয়ে দিরাই থানায় মামলা দায়ের করে। মামলা নং-০১, তারিখ: ০১-০৫-২০২১ ইংরেজি।
দুদুু মিয়ার পরিবারে বর্তমানে স্ত্রী পারভীন বেগম (৩৭), ছেলে তানভীর মিয়া (২২), সুমন মিয়া (২০), ইয়াছিন মিয়া (১২), মেয়ে শারমিন বেগম (১৭), সাজনা বেগম (১৪) ও সাজেদা বেগম (১০) রয়েছে। নিজের কোন সহায়-সম্বল না থাকায় তারা দীর্ঘদিন ধরে চÐিপুুর গ্রামের মৃত আবুল মিয়ার ছেলেদের বাড়িতে কাজ করছে এবং মঙ্গলপুরে তাদের বাড়িতে থাকছে।
নিহত দুদু মিয়ার স্ত্রী পারভীন বেগম জানান, পাওনা টাকার জন্য গত পৌষ মাসে দিরাই থেকে বাড়ি নিয়ে আসার পথে কবিরের খামারের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ৬ বস্তা সার আটক এবং বাড়ি থেকে পানি সেচের মেশিন জোড়পূর্বক নিয়ে যায়। সার দাতা ও বাড়ির মালিক জুয়েল মিয়াকে বিষয়টি অবগত করি। পরে জানতে পারি কবিরই জুয়েল মিয়াকে কল দিয়ে সার আটকের কথা জানায়। তিনি অনুরোধ করলেও সার ও মেশিন ফেরত পাইনি। শেষে দিরাই থানায় বিষয়টি অবগত করালে পুলিশ এসে তা উদ্ধার করে দেয়। এ ঘটনার পর থেকে আমাদের উপর চরম ক্ষুদ্ধ ছিল কবির। গত চৈত্র মাসে নিহত দুদু মিয়ার বড় ছেলে লজ্জাবতী গাছের পাতা আনতে কবিরের খামারে গেলে তাকে মারধরসহ অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে হুমকি দেয় যে, তোর বাপকে কেটে টুকরো টুকরো করে মাছের খাবার বানাবো। এরপর থেকে পরিবারের লোকজন দুদু মিয়াকে খামারের দিকে না যেতে বলেন। পরিবারের লোকজন আরও জানান, দুদু মিয়া নিখোঁজের আগের দিন সোমবার জালালনগরের মির্জা হোসেন তার বাড়িতে এসে কবিরের খামারে পুনরায় কাজ করার প্রস্তাব দেয়। তিনি পরিবারের সকলের সাথে পরামর্শ করে জানাবেন বলেও জানান পারভীন বেগম।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে চÐিপুর গ্রামের মৃত আবুল মিয়ার ছেলে জুয়েল মিয়া জানান, গত পৌষ মাসে দুদুর সার আটক করে কবির। আমি অনুরোধ করলেও সে ছেড়ে দেয়নি। পরে দিরাই থানার পুলিশ গিয়ে উদ্ধার করে দিয়ে আসে বলেও তিনি জানান।
পরিবারের লোকজন আরও জানান, দুদু মিয়া বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় পরনে পুরাতন একটি লুঙ্গি, গেঞ্জি, পায়ে জুতা ও মোবাইল ফোন ছিল। লাশ উদ্ধারের সময় এসব কিছুই পাওয়া যায়নি। তাছাড়া তার মুখে দাঁড়ি ছিল। দুর্বৃত্তরা তার মুখের দাঁড়ি, মাথার চুল, চোখ, দাঁত, নাক, কান, জিহŸা সব কিছু কেটে ফেলেছে বলে লাশ উদ্ধারের সময় পাশে থাকা ভাঙ্গাডহর গ্রামের মন্টু দাস (৪৫) স্বীকার করেন।
এদিকে ক্লুলেস হত্যাকাÐের মূল রহস্য উদঘাটনের জন্য র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। পরবর্তীতে ৪ মে ৭টা ৪০ মিনিটে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন-৯-এর অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল আবু মুসা মোঃ শরীফুল ইসলাম পিএসসির নেতৃত্বে লেঃ কমান্ডার সিঞ্চন আহমেদ ও এএসপি মোঃ আব্দুল্লাহসহ সিপিসি-৩ (সুনামগঞ্জ ক্যাম্প)-এর একটি আভিযানিক দল সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার মঙ্গলপুর এলাকা থেকে দুদু মিয়ার হত্যার সাথে জড়িতদেরকে আটক করে। আটককৃত ব্যক্তিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তারা হত্যাকাÐের পরিকল্পনা, কার্যক্রম এবং মোটিভ স্বীকার করে। আটককৃতদেরকে দিরাই থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আটককৃতরা হলেন দিরাই পৌরসভার দাউদপুর গ্রামের মৃত আব্দুল তোয়াহিদের ছেলে খামারের মালিক নাজমুল হোসেন (৪৯), নরোত্তমপুর গ্রামের মৃত আব্দুল কাইয়ুমের স্ত্রী আল বাহার (৩৫), ফজলুল হকের ছেলে নাসির উদ্দিন (৩৫), মুসলিম উল্লাহর ছেলে লুৎফুর রহমান (৩৫), ভাঙ্গাডহর গ্রামের মৃত জয়দর দাসের পুত্র সত্যরঞ্জন দাস (৫৫), মকবুল আলীর ছেলে আব্দুল মালিক (৩০)।
নিহত দুদু মিয়ার স্ত্রী পারভীন বেগম পরিবারের কর্তা স্বামী হারিয়ে দিশেহারা। তিনি বলেন, অভাবের কারণে বৈশাখ মাসের জন্য চÐিপুরের জুয়েল মিয়ার বাড়িতে কাজ করতে যাই। কাজের ঝামেলার কারণে স্বামী নিখোঁজের খবর পেয়ে বাড়িতে আসতে না পারলেও লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে বাড়িতে আসি। তিনি আরও বলেন, আমার স্বামীর হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তি চাই। আশা করবো, রাষ্ট্র এই নির্র্মম-নৃশংস ও বর্বরোচিত হত্যাকারীদের সর্বোচ্চ শাস্তি বাস্তবায়ন করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করবেন।
দিরাই থানার অফিসার ইন-চার্জ (ওসি) মোঃ আজিজুর রহমান জানান, ঘটনার খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক পুলিশ গিয়ে লাশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য সুনামগঞ্জ পাঠায়। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়ের করে। এ পর্যন্ত ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে ৬ জনকে আটক করা হয়েছে। প্রকৃত ঘটনা কি তা উদ্ধারে পুলিশ তৎপর রয়েছে বলেও তিনি জানান।